হারাধন চন্দ্র দে, আড়াইহাজার প্রতিদিন :-
ঘরের পাশে একটি সুপারি গাছ। সেই গাছে কোনও সুপারি নেই। তারপরও গাছে কেউ একজন উঠেছিল, লেগে আছে কাদা। এই কাদার সূত্র ধরেই বেরিয়ে এলো নারাযণগঞ্জের আডাইহাজারে মা ছেলে জোডা খুনের রহস্য।
চাঞ্চল্যকর এ ঘটনায মো. সাদিকুর নামে এক যুবককে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই)।
সোমবার (১১ জুলাই) সকালে ধানমন্ডির পিবিআই সদর দপ্তরে সংস্থাটির প্রধান ডিআইজি বনজ কুমার মজুমদার সংবাদ সম্মেলনে জানান, ঘটনাটি তদন্ত করতে গিয়ে আমরা কোনও সূত্র পাচ্ছিলাম না। তবে সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায, যে ঘর থেকে কাকলি ও তার ৮ বছরের ছেলে তালহার রক্তাক্ত মরদেহ উদ্ধার করা হয তার বাথরুমের ভেন্টিলেটরের পাশে একটি সুপারি গাছ আছে। সেই সুপারি গাছে কেউ উঠেছিল। সেখানে কাদা লাগানো ছিল। কিন্তু সুপারি গাছে সুপারি না থাকা সত্তেও কেন গাছে উঠা হল? এই সন্দেহ হয় আমাদের। তদন্ত করতে গিয়ে বেরিয়ে আসে লোমহর্ষক সব কাহিনী।
পিবিআই প্রধান বলেন, গ্রেপ্তারকৃত সাদিকুর জুয়ার নেশায় আসক্ত এক যুবক। আইপিএলে জুয়া খেলে দেনায় পরে গিয়ে স্বর্ণালংকার লুটের জন্য মা ছেলেকে খুনের বিষয়টি আদালতে স্বীকার করেছে গ্রেপ্তারকৃত আসামী।
পিবিআই’র জেলা ইউনিট প্রধান মনিরুল ইসলামের তত্ত¡াবধানে মামলাটি তদন্ত করছেন উপপরিদর্শক শাকিল হোসেন।
যেভাবে হত্যার রহস্য বের হয়ে আসে:
পিবিআই খুণের ঘটনা তদন্তে নেমে যখন কোন সূত্র পাচ্ছিলেন না,তখন নিহতের ঘরের পিছনে একটি সুপারী গাছের গোড়া থেকে প্রায় ২ফুট উপরে কিছু কাদামাটির চিহ্ন দেখেন। গাছের উপরে তাকিয়ে গাছে কোন সুপারী নাই দেখতে পেয়ে তদন্ত দলের সন্দেহ হয়। পিবিআই’র তদন্তকারী দল এ বিষয়টি নিয়ে স্থানীয় সোর্স এর মাধ্যমে জানতে পারে নিহত ভাসুরের ছেলে অজিদ কাজী সহ কিছু কম বয়সী কিশোর এ বাড়ির পিছনে বসে ফ্রি ওয়াইফাই দিয়ে মোবাইলে নেট ব্রাউজ করে থাকে। এ তথ্যে পেয়ে অজিদ কাজী সহ বেশ কয়েকজনকে ব্যাপক জিজ্ঞাসাবাদ করে তদন্তকারীদল। জিজ্ঞাসাবাদে একপর্যায়ে অজিদ কাজী জানায়, ২ জুলাই রাত সাড়ে ১০টার দিকে নিহত তালহার চিৎকার শুনতে পায়। পরে তাদের বাথরুমে কারো হাত ধোয়ার শব্দ শুনতে পায় সে। তখন তার কাকির সাথে কারো পরকীয়া সম্পর্ক রয়েছে বলে সন্দেহ করে সে। পরে বাড়ির পেছনে দেয়ালের সাথে লাগানো সুপারী গাছ বেয়ে বাথরুমের ভেন্টিলেটর দিয়ে উকি দিয়ে তাদের এলাকার সাদিকুরকে দেখতে পায়। সে সুপারী গাছ থেকে নেমে ঘটনাস্থলে বসে থাকলে সাদিকুর বের হয়ে যাবার সময় ঘরের পিছনে অজিদ কাজীকে বসে থাকতে দেখে। ঘটনার পর দিন সাদিকুর অজিদকে হত্যার হুমকী দিলে সে ভয়ে এ কথা কাউকে বলেনি। এ তথ্য পাবার পরই ৯জুলাই সাদিকুরকে গ্রেপ্তার করে পিবিআই। পিবিআই জানায়,গ্রেপ্তারকৃত সাদিকুর সাদি(২৪)উজান গোপীন্দী পশ্চিমপাড়া এলাকার মোবারক হোসেনের ছেলে। সে স্থানীয় সাকিব নিটওয়্যার নামে প্রতিষ্ঠানে বৈদ্যুতিক ফিডারম্যান পোষ্টে চাকুরী করে থাকে।
পিবিআই’র জিজ্ঞাসাবাদে সাদিকুর জানায়, সে আইপিএল জুয়া খেলে বেশ কিছু টাকা ঋনগ্রস্ত হয়ে পড়ে। পাওনাদারদের চাপে সে দ্বিধাগ্রস্ত হয়ে পড়ে। ঘটনা দিন সন্ধ্যায় তার কর্মস্থল থেকে ফিরে সে নিহতের বাড়ির পাশে হাটাহাটি করে বিভিন্ন চিন্তা করতে থাকে। রাত সাড়ে ১০টার দিকে নিহত কাকলীর বাড়িতে গিয়ে তাকে ভাবী সম্বোধন করে ডাকাডাকি করে। কাকলী দরজার সামনে এলে মায়ের জন্য বেøন্ডার নিতে এসেছে বলে জানায়। ঐ সময় কাকলী কলাপসিবল গেইট খুললে সাদিকুর ঘরে ঢোকেন । ঘরে ঢুকে শিশু ছেলে তালহাকে ঘুমভাব দেখে কাকলীর কাছে ১০ হাজার টাকা চান সাদিকুর। ঐ সময় কাকলী তার কাছে কোন টাকা নাই জানান। এতে সাদিকুর বিশ্বাস না করায় কাকলী তার আলমারী খুলে তাকে দেখায়। ঐ সময় সাদিকুর আলমারীতে বেশ কিছু স্বর্ণালংকার দেখতে পান। তখন সে লোভে পড়ে কাকলীকে চেয়ারে বসিয়ে গলায় ওড়না পেঁচিয়ে শ্বাসরোধ করে হত্যার পর কাকলীর মাথায় ইস্ত্রী দিয়ে আঘাত করে। পরে সে হত্যা নিশ্চিত করতে কাকলীর রান্নাঘর হতে বটি এনে কাকলীর গলা কাটেন। পরে সে আলমারী থেকে স্বর্ণালংকার দুটি আংটি, দুটি চেইন ও এক জোড়া কানের দুল নিয়ে পাশের রুমে গিয়ে শিশু তালহাকে জবাই করে হত্যা করে।
পিবিআই আসামীকে গ্রেপ্তার করার পর তার স্বীকারোক্তি মতে একটি আংটি,একটি চেইন ও এক জোড়া কানের দুল সাদিকুরের শোবার ঘরের বিছানার তোষকের নিচ থেকে উদ্ধার করে এবং একটি চেইন একটি আংটি রূপগঞ্জ উপজেলার ডারগাঁ এলাকার স্বর্ণ ব্যবসায়ী গোপালের কাছ থেকে জব্দ করা হয়। এগুলো সাদিকুরের মায়ের স্বর্ণ বলে ১৭ হাজার টাকায় গোপালের কাছে বন্ধক রাখে সাদিকুর। এছাড়াও হত্যাকান্ডে ব্যবহৃত বটি,ইস্ত্রী ও রক্তমাখা ওড়না উদ্ধার করা হয়।
গ্রেপ্তারের পর সাদিকুর সিনিয়র জুডিশিয়াল ম্যাজিস্টেট কাওসার আলমের আদালতে ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছে।
পিবিআই জানায়, ময়নাতদন্তর রিপোট হাতে আসার পর আসামীর স্বীকারোক্তি পর্যালোচনা করে আসামীর সর্বোচ্চ শাস্তি নিশ্চিত করতে দ্রুত আদালতে অভিযোগপত্র দাখিল করা হবে।