আড়াইহাজার প্রতিদিন ডেক্স:
নারায়ণগঞ্জের আড়াইহাজারে মা ও ছেলেকে জবাই করে হত্যার ঘটনার ২দিন পর মঙ্গলবার নিহত রাজিয়া সুলতানা কাকলীর মা খন্দকার তাছলিমা বেগম বাদী হয়ে আড়াইহাজার থানায় অজ্ঞাত আসামীদের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করেছে। হত্যার রহস্যের জট খুলতে র্যাব-১১ মঙ্গলবার নিহত রাজিয়া সুলতানা কাকলীর শ্বশুর বাড়ির চাচাতো দেবর সবুজ, নিহত শিশু তালহার চাচাতো ভাইয়ের স্ত্রী জান্নাত বেগম সহ ৫জনকে আটক করে জিজ্ঞাসাবাদ করছে বলে মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা আড়াইহাজার থানার উপপরিদর্শক নূবে ই আলম জানান।
তবে নিহতের পরিবার থেকে অভিযোগ উঠেছে সম্পত্তি গ্রাসের জন্যই মা ও ছেলেকে হত্যা করেছে নিকটাত্মীয়রা। এখন পর্যন্ত সন্দেহ ভাজন হিসেবে কাউকে গ্রেপ্তার করতে পারেনি পুলিশ।
নিহত মা ছেলের ময়নাতদন্ত শেষে সোমবার মাগরীবের নামাজের পর নিহত নাজিয়া সুলতানা কাকলীর পিত্রালয় পাঁচগাও এলাকায় জানাজা শেষে পারিবারিক কবরস্থানে দাফন করা হয় মা ও ছেলেকে।
আড়াইহাজার উপজেলার উজান গোবিন্দী পশ্চিমপাড়া এলাকার মৃত আওয়াল নবীর স্ত্রী রাজিয়া সুলতানা কাকলী ও তার ৮ বছর বয়সী ছেলে তালহাকে নিজ ঘরে শনিবার রাতে ধারালো বটি দিয়ে ও ইস্ত্রি দিয়ে আঘাত করে হত্যা করা হয়। প্রায় ২ বছর আগে স্বামীর মৃত্যুর পর একমাত্র মা ছেলেই বসবাস করতো এই ঘরে।
ঘটনার প্রথম প্রত্যক্ষদর্শী নিহত শিশু তালহার চাচাতো ভাইয়ের স্ত্রী জান্নাতি বেগম জানান,ভোর সাড়ে ৪ টায় ঘরের লোহার গেইট খোলা দেখে তিনি ঘরে প্রবেশ করে। তিনি ডিম লাইট জ্বালিয়ে আলমীরা খোলা ও এলোমেলো দেখে। ঘরের সবকিছু এলোমেলো দেখতে পেলেও খাটের ওপর পরে থাকা তালহার রক্তাক্ত দেহ,মেঝেতে রক্ত ও পাশের ঘরে পরে থাকা চাচির মরদেহ দেখতে পায়নি সে। ঘর এলোমেলো দেখেই সে নাকি ভীত সন্ত্রস্ত হয়ে তার আরেক চাচা শশুর শালফু কে ডেকে নিয়ে আসে। আর তার চাচা শশুরও তখন নাকি তাদের ঘরের পেছনে সিগারেট খাচ্ছিল। চাচাকে ডেকে নিয়ে আসার পরও তারা ঘরে কোন লাশ দেখতে পারেনি। তখন জান্নাতি বেগম তার ঘর থেকে মোবাইল ফোন এনে লাইট জ্বালালে দেখতে পারে খাটে তালহার লাশ ও পাশের রুমে চাচি শাশুরীর লাশ। পরে তার চাচা শ্বশুর শালফু ও সে আর্তচিৎকার করলে আশেপাশের লোকজন আসে।
ঘরে লাইট থাকলেও তা না জ্বালিয়ে মোবাইল ফোন এনে আলো জানালেন কেন? এমন প্রশ্ন এড়িয়ে যান জান্নাতি বেগম।
ঘটনার পরদিন সোমবার তাদের বাড়িতে গেলে দেখা যায় তাদের পরিবারের তেমন কোন শোক তাপ নেই। হাস্যজ্জ্বোল স্বাভাবিক ভাবেই সাংবাদিকদের সাক্ষাৎকার দেন জান্নাতি বেগম। তার সাথে প্রথম লাশের প্রত্যক্ষদর্শী চাচা শ্বশুর শালফু কে ঘটনার দিন এবং পরেরদিন গিয়েও বাড়িতে পাওয়া যায়নি। তার কথা জিজ্ঞেস করলে জানান, দুপুর দুইটায় হাটে গরুর দুধ বিক্রি করতে গেছে।
নিহত মা ছেলের মরদেহ ময়না তদন্তের জন্য পুলিশ নারায়ণগঞ্জ জেনারেল হাসপাতালে পাঠালে সেখানে নিহত রাজিয়া সুলতানা কাকলী বেগমের ভাই ও স্বজনরা ব্যস্ত ছিল। কিন্তু শ্বশুর বাড়ির কেউই যায়নি সেখানে। তাদের দাফনের ব্যাপাড়েও এ বাড়িতে কোন আয়োজন নেই, জানা নেই কোন সময় জানাজা বা দাফন হবে। কখন দাফন হবে জানতে চাইলে কাকলী বেগমের শশুর বাড়ির লোকজন জানায়, তারা এসব কিছুই জানেনা। ঘটনার দিন পুলিশ লাশ নিয়ে গেছে। লাশের সঙ্গে নিহত কাকলীর ভাই ও স্বজনরা রয়েছে। লাশ তারাই নিয়ে আসবে দানের ব্যাবস্থা তারাই করবে। লাশ নিয়া আসলেইতো তারা খবর পাবেই।
পাশের দুপ্তারা ইউনিয়নের পাঁচগাও এলাকায় নিহতের বাবার বাড়িত গিয়ে দেখা যায় তারা সবাই শোকাহত। ফোনে লাশের খবর নিচ্ছে কিছুক্ষণ পর পর। আয়োজন করছেন দাফনের।
এসময় নিহতের স্বজনদের কাছে হত্যার রহস্য জানতে চাইলে তারা জানান,নিহতদের পাশের ঘরেই বসবাস করেন ভাতিজা বৌ জান্নাতি। বিভিন্ন সময় লোহার গেইটের শব্দ পেলে এবং ফোনে কথা বললেও শুনতে পায় সে। আর সেদিন দুইটি মানুষকে কুপিয়ে হত্যা করলো, তারা বাঁচার জন্য দাবরালো ও চিৎকারের কোন শব্দ পেলনা আশেপাশের ঘরের লোকজন। আলমারী ভাঙ্গার শব্দ পেলনা। প্রথম ঘরে প্রবেশ করে ডিম লাইট জালিয়ে আলমারী ও আশে পাশে এলোমেলো চোখে পড়লেও লাশ তার চোখে পরেনি। পরে গিয়ে চাচাকে ডেকে নিয়ে এসে মোবাইলের লাইট দিয়ে দেখলো এটাই বেশ রহস্যজনক।
নিহতের বোন শাহিনা সুলতানা তিথী জানান, সম্পত্তি আত্মসাতের জন্যই মা ও ছেলেকে হত্যা করা হয়েছে। শশুর বাড়ির লোকজন সম্মেলিত ভাবেই এ হত্যাকান্ড ঘটিয়েছে বলে তিনি অভিযোগ করেন। এছাড়াও কাকলী বেগমের চাচাতো দেবর ৪ বছর আগে দেড়লাখ টাকা নিয়েছে ব্যাবসার কথা বলে। সেই টাকার জন্যও ইদানিং চাপ দেয়া হচ্ছিল। সেই ঘটনাটি নিয়েও সন্দেহ করছেন তারা।
তিথী বলেন, হত্যাকারীদের একজন অবশ্যই নারী হবে। কারণ তারবোন পর্দাশীল। ঘুমানোর পোশাক পড়া অবস্থায় কখনোই দরজা খুলতো না। যেহেতু হত্যার জন্য গেইটের তালা ভাঙতে হয়নি খুনিদের। এবং হত্যার কাজে ব্যাবহৃত বটি এবং ইস্ত্রী তাদের ঘরেরই। তাহলে নিকটাত্মীয় ঘরে আসা যাওয়া করে এমন না হলে খুনিরা বটি ও ইস্ত্রী কোথায় আছে তা জানতো না। আর আলমিরা ভেঙ্গে এলোমেলো করে ডাকাতির ঘটনা সাজানোর চেষ্টা করেছে খুনিরা। কারণ ঘর থেকে কিছুই খোয়া যায়নি।
এদিকে এলাকাবাসী নিহত কাকলী বেগম ও তাদের পরিবারের লোকজনকে খুবই শান্তশিষ্ট হিসেবে চিনেন। কাকলী বেগমের সঙ্গে কারো সত্রুতা আছে বা ঝগড়া হয়েছে এমন কোন খবর তাদের জানা নেই এবং খুবই নম্র সভাবের শিশু তালহাকেও হত্যা করতে হবে এমন শত্রুতা তো দূরের কথা কারো সঙ্গে সামান্য বিবাদ আছে কাকলী বেগমের এমন খবরও তাদের জানা নেই। আত্মীয় স্বজন ছাড়া কারো সাথে চলেফেরা নেই নিহতের। তাই হত্যার রহস্য কি তারা তা চিন্তাই করতে পারছেন না।
পুলিশ হত্যার কোন ক্লু ও সন্দেহভাজন এমন কাউকেও শনাক্ত করতে পারেননি তারা। পুলিশ জানায়, বেশ কয়েকটি দিককে প্রধান্য দিয়ে তারা তদন্ত কাজ করেছে। থানা পুলিশের পাশাপাশি ডিবি,পিবিআই,র্যাব সহ কয়েকটি টিম কাজ করছে। খুনের রহস্য উদঘাটন করে খুনিদের আইনের আওতায় আনবে বলে জানান তদন্তকারী কর্মকর্তা।
নিহতের পরিবার থেকে জানানো হয়, ময়না তদন্ত ও লাশ দাফন শেষ করে মামলার জন্য থানায় অভিযোগ করেন।
দশ বছর আগে উজান গোবিন্দি পশ্চিম পাড়া গ্রামের মালয়েশিয়া প্রবাসী আউয়াল নবীর সঙ্গে রাজিয়া সুলতানা কাকলীর বিয়ে হয়। গত ২ বছর আগে আউয়াল ব্রেন স্ট্রোকে আক্রান্ত হয়ে মারা যান। টিনশেড বিল্ডিংয়ে ছেলে তালহাকে নিয়ে স্বামীর ভিটায় থেকে যায় সে। শুক্রবার রাতের যে কোন সময়ে নিজ ঘরে খুন হয় মা ছেলে। শনিবার সকালে পুলিশ তাদের লাশ উদ্ধার করে। নিহত শিশু তালহা মনোহরদী মডেল একাডেমীর দ্বিতীয় শ্রেনীর ছাত্র।
আড়াইহাজার থানার ওসি আজিজুল হক হাওলাদার জানান, পুলিশ সহ একাধিক সংস্থা খুনের রহস্য উদঘাটনে কাজ করছে। খুব দ্রুতই জড়িতদের গ্রেপ্তারে পুলিশ কাজ করছে বলে জানান।